একজন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের গুণাবলী কি?
একজন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের গুণাবলী হলঃ
১. জীবনীশক্তি: জীবিত মানুষের মধ্যে জীবনীশক্তির অস্তিত্বে বিশ্বাস করা। সুস্থতা, রোগাবস্থা এবং রোগ আরোগ্য এই তিন অবস্থা জীবনীশক্তির পরিবর্তন মাত্র। জীবের ক্রিয়া ক্ষমতাকেই এক কথা বলা হয় জীবনীশক্তি। এই জীবনী শক্তি সম্পর্কে ভালোভাবে জ্ঞান রাখতে হবে।
২. ভেষজের শক্তিতে বিশ্বাসী হওয়া: ঔষধের গুণগত শক্তি যে অসীম ক্রিয়ার অধিকারী, তাহা অনুধাবন করতে পারলেই বুঝতে পারবে, জীবাণুর সূ² শক্তি ও জীবনীশক্তির উপর এই ওষুধের শক্তি কাজ করতে সক্ষম।
৩. সত্যানুরাগী: মহাত্মা হ্যানিম্যান পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষার দ্বারা যাহা অসত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে, তাই ত্যাগ করেছেন এবং একমাত্র পরীক্ষালদ্ধ সত্যকেই আঁকড়ে ধরে ছিলেন। একজন চিকিৎসককে সত্যের প্রতি অনুরাগী হতে হবে। মহাত্মা হ্যানিম্যান কখনই কোন প্রকার ভিত্তিহীন মতবাদ, যুক্তিহীন অভিজ্ঞতা গ্রহণ করতেন না।
৪. ৬ষ্ঠইন্দ্রিয় সচল: হোমিওপ্যাথ চিকিৎসকের প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয় খুব প্রখর শক্তি-সম্পন্ন হওয়া একান্ত দরকার।
শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, ঘ্রাণশক্তি, জিহŸা, চর্ম ও বুদ্ধিবৃত্তি ইত্যাদির যে কোন একটি কম শক্তি সম্পন্ন হলে সঠিক রোগী-চিত্র সম্ভব হয় না।
ডা. রাইট বলেছেন-“ডাক্তারকে অবশ্যই গ্রহণ দক্ষতা সম্পন্ন হতে হবে, যেমন- একটি ফটোগ্রাফির প্লেট এর মত। যাতে করে রোগীর রোগচিত্র সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে পারে।”
৫. রোগীলিপি প্রস্তুত করণ: একজন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের গুণাবলী হল বিশ্বস্ততার সাথে মহাত্মা। হ্যানিম্যানের নির্দেশিত পন্থায় রোগীলিপি প্রস্তুত করার কৌশল জানা থাকতে হবে। চিররোগে রোগীলিপি ছাড়া চিকিৎসা করা অসম্ভব। শুধুই কি চিররোগ, তরুন রোগেও রোগীলিপি ব্যতীত ওষুধ নির্বাচন সম্ভব নয়। রোগীলিপি প্রস্তুত না করলে ওষুধের ক্রিয়া নির্ণয় করা বা দ্বিতীয় ব্যবস্থাপত্র দেয়া কোন প্রকৃত হোমিওপ্যাথের পক্ষে সম্ভব নয়।
৬. বদ্ধমূল ধারণা: আমার মতে এই প্যাথির অগ্রগতির অন্তরায় হিসেবে বদ্ধমূল ধারণা, এটি অন্যতম প্রধান কারণ।
পূর্বসূরীরা রোগীদের এক/দুই কথায় কোন ওষুধ ব্যবহারে, কোন ফল পরীলক্ষিত হয়ে থাকলে।
পরবর্তি প্রজন্ম সেই ওষুধটি সেইরূপ রোগের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকে।
অথচ রোগ একই রোগীর লক্ষণ ভিন্ন এর ফলে রোগীরা আরোগ্য হয় না।
এরূপ পূর্বসূরীর অনুসরণ করাই বদ্ধমূল ধারণা। এইরূপ ধারণা পরিহার করতে হবে।
৭. রোগ উৎপত্তির কারণ: হোমিওপ্যাথিক রীতি অনুসারে রোগের উত্তেজক, পরিপোষক ও মায়াজমেটিক কারণগুলি সম্পর্কে ভালোভাবে জানা থাকতে হবে।
জীবাণু রোগ সৃষ্টি করে, কিন্তু জীবাণু আক্রমণের পূর্বে জীবাণু আক্রমণের পরিবেশ থাকতে হবে।
পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে জীবনী শক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে, জীবাণু আক্রমণের পরিবেশ তৈরি হয়।
এটাকে ডায়াথেসিস বলে। এই ডায়াথেসিস অবস্থায় জীবাণু আক্রমণ করে।
(উৎপত্তির কারণ বিস্তারিত জানতে হলে আমার লেখা রোগীলিপি-২ বইতে পাবেন)
৮. পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা: একজন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের গুণাবলী হল পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, এই প্যাথিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান।
রোগীলিপি তৈরি, রোগচিত্র অষ্কন, ওষুধ নির্বাচন ও রোগীকে ওষুধ সেবন করানোর পর তাহার প্রতিক্রিয়া নির্ধারণ করতে পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতা অত্যন্ত প্রয়োজন।
এই পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা কম থাকলে, সফলতা অর্জন করা যাবে না।
৯. লক্ষণের মূল্যায়ন: রোগীলিপি সম্পূর্ণ করার পর লক্ষণের মূল্যায়ন দ্বারা রোগীর জন্য সাদৃশ্যতম ওষুধ নির্বাচন করতে হয়।
রোগীলিপি থেকে অসাধারণ, অদ্ভুত, একক, বিরল ও দৃষ্টি আর্কষণীয় লক্ষণ খুঁজে বের করতে হবে।
এই কাজটি যে যত ভালোভাবে করতে পারবে তার সফলতাও তত বেশী হবে।
১০. রোগ-আরোগ্যের পথে বাধা: রোগ-আরোগ্যের পথের বাধাগুলি সম্পর্কে জানা থাকতে হবে এবং সে সকল বাধা থেকে পরিত্রানের উপায়ও জানতে হবে। রোগ-আরোগ্যের পথে বাধাগুলি দূর না করে ওষুধ প্রয়োগ করতে থাকলে, কোন ফলাফল পাওয়া যাবে না। রোগী আরোগ্য হবার প্রশ্নই উঠেনা।
১১. খাদ্য ও পথ্য: রোগ ও রোগীর পক্ষে ক্ষতিকর পথ্য, খাদ্য, পানীয়, অন্যান্য দ্রব্যাদি, বাসস্থান ও পারিপার্শি¦ক পরিবেশ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত থাকতে হবে।
রোগীকে ওষুধ দেবার পাশাপাশি পথ্য, খাদ্য, পানীয়, বাসস্থান ইত্যাদি সস্পর্কে তাকে সচেতন করে দিতে হবে।
১২. মায়াজম: মায়াজম তত্তে¡ বিশ্বাসী হতে হবে। মায়াজম সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখতে হবে।
চিররোগ সমূলে নির্মূল করার জন্য হ্যানিম্যানের দেখানো এন্টি মায়াজমেটিক ওষুধ ব্যবহার করতে হবে।
তা না হলে চিররোগ কখনো নির্মূল না হয়ে, বার বার ফিরে আসবে।
রোগীরা শুধুই উপশম পাবে, কখনো আদর্শ আরোগ্য পাবে না।
১৩. একক মাত্রা: একক মাত্রা সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে।
পঞ্চাশ সহস্রতমিক পদ্ধতিতে শক্তিকৃত সুনির্বাচিত ওষুধের একক মাত্রায় অনেক সময় তরুন রোগ সম্পূর্ণ সেরে যায়।
এই একক মাত্রায় কি ফলাফল দিতে পারে, সে সম্পর্কে জানা থাকতে হবে।
ঔষধ প্রয়োগের পর দেহ ও মনে যে পরিবর্তন আসে তা ভালোভাবে অনুধাবন করতে হবে।
একক মাত্রার ফলাফল না বুঝে, রোগীকে পুনঃরায় ওষুধ প্রয়োগ করলে আদর্শ আরোগ্য ব্যাহত হবে।
১৪. একক ওষুধ: রোগীর সমস্যা যাই হোক না কেন, যতই জটিল কিংবা মারাত্মক হোক না কেন?
রোগীর ওষুধ হবে একটি। কারণ এই ওষুধগুলি প্রæভিং করা হয়েছে একটি করে, তাই এর বাহিরে কোন কথা চলবে না। রোগীর দেহ একটি সুতরাং ওষুধও একটি।
১৫. দ্বিতীয় ব্যবস্থাপত্র: ২য় ব্যবস্থাপত্র কি?, কেন?, কোথায়?, কখন এবং কিভাবে নির্ণয় করতে হবে, সে সকল বিষয়ে জানা থাকতে হবে।
২য় ব্যবস্থাপত্রে ওষুধ, ওষুধের শক্তি ও মাত্রার ক্ষেত্রে পরিবর্তন হয়ে থাকে। এই কাজটি চিকিৎসকের ভালোভাবে জানা থাকা দরকার।
১৬. ওষুধের অপব্যবহার: উচ্চশক্তিযুক্ত হোমিওপ্যাথিক ওষুধের অপব্যবহারের ফলে রোগীর যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, সে সম্পর্কে চিকিৎসকের জানা থাকতে হবে।
১৭. ভুল অপেক্ষা: ভুল ওষুধ প্রয়োগ করে, মাসের পর মাস অপেক্ষা করা।
সঠিক ভাবে নির্বাচিত (ওষুধ) দশমিক ও শততমিক পদ্ধতিতে শক্তিকৃত ওষুধ প্রয়োগ করে, ওষুধের ক্রিয়াকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
কিন্তু কেহ ভুল ওষুধ প্রয়োগ করে দিনের পর দিন বিনা ওষুধে অপেক্ষা করা, এটা রোগীর উপর জুলুম ছাড়া আর কি হতে পারে।
১৮. সাময়িক উপশম-প্রদানকারী ওষুধ: কোন কোন ক্ষেত্রে সাময়িক উপশম-প্রদানকারী ঔষধের প্রয়োগ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে ওষুধটি(পঞ্চাশ সহস্রতমিক পদ্ধতিতে শক্তিকৃত) সুনির্বাচিত হলে বেশী হালকা(কাপিং) করে ব্যবহার করলেই চলবে। শক্তি গ/২ থেকে শুরু করতে হবে।
১৯. ওষুধ সম্পর্কে জ্ঞান: একজন চিকিৎসকের ওষুধ সম্পর্কে অনেক জ্ঞান থাকতে হবে। ওষুধ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য নিয়মিত মেটেরিয়া মেডিকা অধ্যয়ন করতে হবে। হ্যানিম্যানের মেটিরিয়া মেডিকা পিউরা, অ্যালেনের এনসাইক্লোপিডিয়ার মত পুস্তক পড়ে ওষুধ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
২০. ওষুধের ক্রিয়াকাল: যে সকল চিকিৎসক দশমিক ও শততমিক পদ্ধতিতে শক্তিকৃত ওষুধ প্রয়োগ করেন, তাদের ক্ষেত্রে ওষুধের ক্রিয়াকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে ২য় ব্যবস্থা পত্র নির্ণয় করতে হবে।
২১. হোমিওপ্যাথির মূল নীতি: হোমিওপ্যাথির মূল নীতিগুলির উপর শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং কোন কারণেই এই নীতির বাহিরে চলা যাবে না।
টাকা পয়সা বেশী উপার্জনের জন্য নীতি বর্হিভূত কোন কাজ করা যাবে না।
শত কষ্টের মাঝেও এই প্যাথির নিয়ম-নীতির বাহিরে না চলার প্রতিজ্ঞায় অটল থাকা।
২২. মিশ্র বর্জন: একজন চিকিৎসক কখনই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার সঙ্গে অন্য কোন প্যাথির ওষুধ ব্যবহার করবেন না।
এমন কি প্রকৃত হোমিওপ্যাথ শক্তিকৃত ওষুধের সঙ্গে অন্য কিছু তথা বয়োকেমিক ওষুধ ও মাদার টিংচার পর্যন্ত ব্যবহার করবেন না।
২৩. প্রকৃত মানুষ: যিনি হবেন সৎ, দয়াবান, পরোপকারী, রোগীদের জন্য সহায়ক, স্রষ্টার প্রতি আনুগত্যশীল, আত্মঅহংকার মুক্ত, পরিশ্রমী, সংযতবাক, ভদ্র, আমানতদারী এতসব গুণে গুণান্বিত।
২৪. জুনিয়র চিকিৎসকদের আশ্রয়স্থল: চিকিৎসক চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি, নবীন চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখবেন।
যাতে করে নবীন চিকিৎসকগণ পাশ করে চেম্বার করতে ভয় না পায়। এর ফলে দেশ ও জাতির উন্নতি হবে।
২৫. নামে-কামে: লোকজন যেন বলেন, তিনি নামেও যেমন ডাক্তার, কাজে-কর্মে, ব্যবহারে সকল ক্ষেত্রেই ডাক্তার।
ওনার সকল কাজ কর্মে যেন ডাক্তারের ছাপ লেগে থাকে। ওনার মতন এতো ভালো মানুষ হয় না।
২৬. তাড়াহুড়া: রোগী পর্যবেক্ষণ, রোগীলিপি, ওষুধ বাছাই, ওষুধ তৈরি, রোগীকে ওষুধ বুঝিয়ে দেয়া, সকল ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া না করা।
সকল কার্যক্রম ধৈর্য সহকারে করতে হবে কোন প্রকার তাড়াহুড়া করা যাবে না।
২৭. রোগীর প্রতি ব্যবহার: রোগীকে তুমি সম্বোধন করা যাবে না।
রোগী পর্যবেক্ষণ কিংবা রোগীর সঙ্গে কোন কিছু বিনিময়ের ক্ষেত্রেও বাম হাত ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নিষেধ।
২৮. সর্তকতা ও মনোনিবেশ: রোগী পর্যবেক্ষণ, রোগীলিপি, ওষুধ বাছাই, ওষুধ তৈরি, রোগীকে ওষুধ বুঝিয়ে দেয়া, সকল ক্ষেত্রে সর্তকতা ও মনোযোগ সহকারে করতে হবে।
২৯. সময়নিষ্ঠা: চিকিৎসককে সময় সম্পর্কে এতই সচেতন হতে হবে, যাতে করে তার জীবনের প্রত্যেকটি মিনিটের মূল্য দেন।
তাহলে সে রোগীদের কষ্টের ও সময়ের মূল্য বুঝবেন।
৩০. অধ্যয়ন: নিত্য নতুন বা সাম্প্রতিক চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে নিয়মিত অধ্যয়ন করতে হবে। এটি শুধু নিজস্ব প্যাথির ক্ষেত্রেই নয়, বরং এটি সাধারণ ওষুধ এবং অন্য প্যাথি সম্পর্কে জানার জন্য।