শিশুদের পেটে ব্যথার হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা

শিশুদের পেটে ব্যথার হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা

শিশুদের পেটে ব্যথার হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা, আমরা নিজেদের রোগের যন্ত্রণায় যতটা না কাবু হই, তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাই যদি আমাদের ছোট্ট সোনামনিটা রোগে কষ্ট পায়। যখন অসময়ে সে যন্ত্রণায় কষ্ট পায় এবং হাতের কাছে কোন ভালো চিকিৎসক পাওয়া সম্ভব হয় না- অথচ শিশুটি কেঁদে কেঁদে সেই নিরুপায় বাবা-মায়ের কোলেই যন্ত্রণামুক্তির আশায় ফিরে ফিরে আসে, কতটা অসহায়ই না তখন মনে হয় নিজেকে। প্রতিটা বাবা-মা ই তখন ভাবেন, কোন একটা কিছু যদি করতে পারতাম এই অসহায় অবোধ শিশুটির জন্যে।

শিশুদের ভয়ানক-যন্ত্রণাদায়ক সরল রোগগুলির মধ্যে একটা হচ্ছে- পেটে ব্যথা। হঠাৎ পেটে ব্যথার পেছনে অনেক জটিল জটিল কারণ, কঠিন কঠিন রোগ থাকতে পারে। সেগুলোর বিশদ উল্লেখ করে ভয় দেখানো আজকের এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। শুধু অতি সাধারণ বাবা-মা, যারা যন্ত্রণার প্রথম অবস্থায় তাৎক্ষণিকভাবে বাচ্চার জন্য কিছু করতে চান, তাদের জন্য সাধারণভাবে এটা লেখা। যদি পেছনে কোন জটিল কারণ না থাকে, তবে ঠিক ঠিক নির্দেশনা মোতাবেক ঔষধ দিলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুর যন্ত্রণা থেকে তাৎক্ষণিক মুক্তি সম্ভব। পেট ব্যথার ডায়াগনোসিস সংক্রান্ত জটিলতাতে হাত দিচ্ছি না। সেটা অভিভাবকের সাধারণ জ্ঞানের উপরই ছেড়ে দিচ্ছি। August Bier এর একটা মন্তব্য এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিকভাবেই এসে যায়,

“A smart mother makes often a better diagnosis than a poor doctor”.

কাজেই, এইসব স্মার্ট মায়েদের সাধারণ জ্ঞানের সম্মানে এই লেখাটি প্রকাশ করছি। তবে, আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, এটা কোন চিকিৎসকের নিকট চিকিৎসা গ্রহণের বিকল্প নয়। এ সমস্ত ক্ষেত্রে বাসায় প্রথম ঔষধটি প্রয়োগ করার পর, যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ ভালো চিকিৎসকের কাছে শিশুকে নিয়ে যাবেন।

এখানে উল্লেখ্য, হোমিওপ্যাথিক ঔষধ ধীরে কাজ করে, এটা সম্পূর্ণই ভূয়া কথা। এসমস্ত ক্ষেত্রে শিশুর যন্ত্রণা হোমিওপ্যাথিক ঔষধে ৫ মিনিট থেকে সর্বোচ্চ ১৫ মিনিটের মধ্যে কমে যাবে, অন্যত্থায় বুঝবেন শিশুর পেট ব্যথার জন্য ঠিক ঔষধটি পড়েনি, অথবা পেট ব্যথাটি একেবারে সাধারণ জাতের ব্যথা নয়।

শিশুদের পেটে ব্যথার হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ধরন

প্রথমেই আমি যে সমস্ত কারণে পেট ব্যথা দেখা দিতে পারে, তার উল্লেখ করে- প্রধান প্রধান ঔষধ এখানে উল্লেখ করছি-

১. মা রেগে থাকা অবস্থায় বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর পর থেকে বাচ্চার পেটব্যথা – Chamomilla

২. মা শোকগ্রস্থ থাকা অবস্থায় বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর পর থেকে তার পেটব্যথা- Ignatia

৩. বাচ্চা পেস্ট্রি বা মেয়োনিজ খাওয়ার পর পেটব্যথা- Pulsatilla

৪. অতিরিক্ত ঝাল বা তৈলাক্ত খাবার খাওয়ার পর থেকে পেটব্যথা- Nux vomica

৫. কৃমির সাথে পেটব্যথা – Cina, Spigelia

৬. রোদ্রে ঘুরে আসার পর পেটব্যথা- Colocynthis

৭. বাচ্চাকে বকাবকি করার পর থেকে তার পেটব্যথা- Colocynthis, Ignatia

৮. ফল খাওয়ার পর থেকে পেটব্যথা- Colocynthis

৯. দৌড়াদৌড়ি করে শরীর গরম অবস্থায় ঠান্ডা পানি খাওয়ার পর দেখা দিলে- Colocynthis

১০. দুধ খাওয়ার পর থেকে পেটব্যথা- Magnesia mur

১১. হঠাৎ উত্তেজিত হওয়ার পর দেখা দিলে – Colocynthis

১২. মনে কোন ক্ষোভ সৃষ্টি হবার পর দেখা দিলে- Staphysegria

১৩. দাঁত উঠার সময়, পায়খানা কষা হয়ে পেটব্যথা দেখা দিলে- Magnesia mur

১৪. দাঁত উঠার সময়, সবুজ পায়খানার সাথে দেখা দিলে- Chamomilla

এখন কিছু কিছু বিশেষ লক্ষণের কথা মনে রেখে, পেটব্যথার সময় যে ঔষধগুলো দিতে হবে তা উল্লেখ করছি-

১. পেটব্যথায় যখন শিশু যখন খুব জোরে কান্না করে, শুধুমাত্র কোলে নিয়ে হাটলে সামান্য আরাম পায় মনে হয়- Chamomilla

২. পেটব্যথায় যখন শিশু যখন মিনমিনে কান্না করে, শুধুমাত্র কোলে নিয়ে হাটলে বা বাইরে নিয়ে ঘুরলে আরাম পায় – Pulsatilla

৩. পেটব্যথায় যখন শিশু উপুর হয়ে শুতে চায় কিংবা পেটে চাপ দিয়ে কোলে রাখলে ভালো থাকে – Colocynthis

৪. পেটব্যথায় যখন শিশু পা দুটো উপরে তুলে পেটের সাথে ঠেকিয়ে থাকে- Magnesia phos, Colocynthis

৫. পেটব্যথার সাথে খিঁচুনি – Belladonna, Cicuta

৬. বায়ু হলে আরাম পায়- Colocynthis, China, Carbo-veg

৭. চাপে ও তাপে আরাম হয়- Magnesia phos

৮. পেটব্যথা, সাথে লাল রংয়ের প্রস্রাব – Lycopodium

৯. পেটে চাপ দিলে বা সামনে ঝুঁকলে ব্যথা বাড়ে- Dioscorea

১০. সোজা হয়ে বসে থাকলে আরাম- Sinapis nigra, Dioscorea

১১. পেটব্যথা, সাথে টক গন্ধযুক্ত পায়খানা- Rheum

১২. পেটব্যথার সাথে লাল মুখ, গরম ঘাম- Chamomilla

১৩. পেটব্যথায় পেটে ডললে কমে- Magnesia phos

১৪. পেটব্যথার সাথে লাগাতার হিক্কা- Hyoscyamus

১৫. ব্যথার সময় পেটে কাউকে ছুঁতেও দেয় না- Nux vomica

১৬. ব্যথার সময়, পা খুব ঠান্ডা- Colocynthis

১৭. পায়খানা করলে পেটব্যথা কমে- Nux vomica, Colocynthis

১৮. বদহজম বা কষার কারণে পেটব্যথা দেখা দিলে- Magnesia mur

১৯. বমির ভাব বা বমির সাথে- Colocynthis

২০. খাবার বা পানি খেলে বাড়ে- Colocynthis, Nux vomica

শিশুদের পেটে ব্যথার হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা

আসলে এই তালিকা আরো অনেক বড় করা সম্ভব। কিন্তু তারপরও মোটামুটি এইগুলো মনে থাকলে জরুরি প্রয়োজনকে পাড়ি দেবার জন্য যথেষ্ঠ হবে। এবার পেটব্যথার ক্ষেত্রে যে ঔষধগুলো বেশি বেশি ব্যবহৃত হয়, তার কিছু লক্ষণ এখানে উল্লেখ করছি। উল্লেখিত বিশেষ লক্ষণগুলো বা অবস্থাগুলোর সাথে এই ঔষধগুলোর বিস্তারিত মিলে গেলে, শিশুর নিশ্চিন্ত আরোগ্য আশা করা যায়।

Chamomilla:

প্রচন্ড রাগ, চিৎকার চেঁচামেচি করে। শুধু কোলে উঠে ঘুরতে চায়। শরীরে স্পর্শ করলে রেগে যায়। দাঁত উঠার সময় সমস্যাগুলো দেখা দেয়। এক গাল লাল ও এক গাল ফ্যাকাসে থাকে অনেক সময়। পায়খানা সবুজ, টুকরো করা ঘাস বা পাতাকপির মতো দেখতে হয়। শব্দ, গান এগুলোতে প্রচন্ড বিরক্ত হয়। ঘুমের মধ্যে কান্না করে। পেটে গ্যাস থাকে, তার সাথে মুখ লাল এবং গরম থাকে।

Colocynthis:

সহজেই রেগে যায়। ব্যথায় অস্থির থাকে। জোরে চাপ দিলে যে কোন ব্যথা কমে। উপুর হয়ে শুলে বা পেটে বালিশ দিয়ে চাপ দিলে, কিংবা উপুর হয়ে বসে পেটে চাপ দিলে ব্যথা কমে। যে কোন ধরণের উত্তেজনা বা রাগে সমস্যা বাড়ে বা তা থেকেই সমস্যা শুরু হয়। পেটে খামচে ধরা ব্যথা- বিশেষ করে নাভীর চারদিকে। কোন কিছু খেলে, বিশেষ করে ফল খেলে বাড়ে। শক্ত আবেগজনিত কারণেও বাড়ে।

Dioscorea: তীব্র পেটব্যথা, পেছনে বেঁকে বসলে বা একদম সোজা হয়ে বসে থাকলে কমে। সামনে ঝুঁকলে বাড়ে, ঢেকুর হলে কম হয়। পেটে গ্যাস হয়ে ব্যথা। পেট ভুটভাট হয়ে বায়ু হয়। পেট স্পর্শ করলে খুব ব্যথা পায়, সামান্য চাপেই কাবু হয়। খাওয়ার পরেই গ্যাস বাড়ে। পেট ব্যথার সময় হাত-পা ঠান্ডা হয়ে থাকে।

Magnesia mur: শব্দ, গোলমাল, ঝগড়াঝাটি খুব অপছন্দ। সকালে ঘুম থেকে উঠার পর সমস্যা বেশি থাকে। পেট ব্যথায় হালকা চাপ দিলে ব্যথা পায়, কিন্তু জোরে চাপ দিলে আরাম হয়। পায়খানা খুব শক্ত হয়, গুটলে গুটলে হয়। দুধ বা ফল খাওয়ার পর পেটব্যথা বা ডায়রিয়া। দাঁত উঠার সময় বাচ্চাদের কষা। পেটে গ্যাস বেরুতে না পেরে পেটব্যথা শুরু হয়। ডান কাত হয়ে শুতে চায় না। ঢেকুরে পঁচা ডিম বা পেঁয়াজের গন্ধ থাকে।

Magnesia phos: চাপে ও তাপে পেটব্যথা কমে। ঠান্ডায় বাড়ে। গরম কিছু খেলে, পেটে ডলে দিলে বা বাঁকা হলে পেটব্যথা কমে। শব্দ, গান, উত্তেজনাতে বিরক্ত হয়। পেট গ্যাস হয়ে ফুলে উঠে, ভরা ভরা লাগে, কাপড় আলগা করে দিতে বলে, বাচ্চারা কাপড় খুলে রাখতে চায়। লাগাতার বায়ু হতে থাকে। থেকে থেকে হিক্কা হয়।

Nux vomica:

বাচ্চার মেজাজ খারাপ থাকে, অধৈর্য্য থাকে। আটো সাটো কাপড় পড়তে চায় না। খাওয়ার কিছুক্ষণ পর পেটব্যথা বাড়ে। গরমে বা পেটব্যথায় গরম কিছু লাগালে আরাম পায়। পেট সাংঘাতিক স্পর্শকাতর হয়ে থাকে। পেটে খামচানো ধরণের ব্যথা থাকে, ব্যথার সাথে সাথে পায়খানার বেগ হয় কিন্তু পরিস্কারভাবে পায়খানা হয় না। অনেক সময় পায়খানা না করেই ফিরে আসে। তবে পায়খানা হলে পেটব্যথা কমে।

Pulsatilla:

তৈলাক্ত খাবার, পেস্ট্রি, মেয়োনিজ খাওয়ার পর পেটব্যথা। বাচ্চা মিন মিন করে কাঁদতে থাকে। বাচ্চা কোলে নিয়ে বাইরে খোলা জায়গায় নিয়ে যেতে বলে। গরম ঘরে ও গরম কিছু খেলে বা গরম প্রয়োগে বাড়ে। ঠান্ডায় আরাম হয়। পেট ফুলে থাকে, শব্দ করে পেট ভুটভাট করে। সন্ধ্যার দিকে শরীরে শীত করে পেটব্যথা শুরু হয়। পেট ভার হয়ে থাকে, মনে হয়, পেটে একটা পাথর পড়ে আছে। পানির পিপাসা থাকে না, যদিও গলা-মুখ শুকিয়ে থাকে।

Belladonna:

প্রচন্ড পেটব্যথা। হঠাৎ শুরু হয়, আবার হঠাৎ চলে যায়। পেট গরম হয়ে যায়। পেটব্যথার সময় চোখ-মুখ লাল হয়ে যায়। বমি বা বমির ভাব থাকে। পেটব্যথায় বাচ্চা খুব জোরে কান্না করে। চেহারায় যন্ত্রণার ছাপ সুস্পষ্টরুপে পড়ে। সামান্য ঝাঁকিও সহ্য করতে পারে না। ঠান্ডা পানি খেতে চায়। পেটে ঠান্ডা লাগালে ও ঠান্ডা পানি খেলে পেটব্যথা কমে। পানির পিপাসা কমে যায়।

বাচ্চাদের পেটব্যথার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের একটা কথা মনে রাখতে অনুরোধ করছি। অনেকসময়, পারিবারিক সম্পর্কগুলোর নেতিবাচক অবস্থা এবং ব্যস্ত জীবনে বাচ্চার দিকে যথেষ্ঠ মনোযোগের ঘাটতি তার উপর এতটাই প্রভাব ফেলতে পারে যে, তাতে (হতে পারে সে সদ্যোজাত শিশু) প্রাথমিকভাবে বাচ্চার পেটব্যথা দেখা দিতে পারে। কাজেই, শিশুকে সার্বিকভাবে সুস্থ রাখতে চাইলে, পারিবারিক সম্পর্ক, শিশুর সাথে অভিভাবকের স্পর্শ ও যত্নের সম্পর্ক, পরিবারের খাবার- বিশেষ করে মায়ের খাবার, মেজাজ, মানসিক অবস্থা ইত্যাদি ব্যাপারগুলোকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় রাখতে হবে। কোন কোন শিশুর বার বার পেট ব্যথা দেখা দেবার প্রবণতা থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে, পরিবারে সম্পর্ক বা খাবারজনিত কোন সমস্যা থাকলে তা খুঁজে বের করে দূর করার মাধ্যমে এবং  ভালো কোন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের নিকট অল্প কিছুদিনের চিকিৎসায়ই তা থেকে শিশুকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা সম্ভব।

বিঃদ্রঃ- ডাক্তারের পরার্মশ ছাড়া ঔষধ খাবেন না।ডাক্তারের পরার্মশ ছাড়া ঔষধ খেয়ে বিপদ ঢেকে আনবেনা।অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন, সুস্থ থাকুন।

2