ক্যালকেরিয়া কার্ব (Calcaria Carb) হল ডা. হানেমানের অন্যতম প্রধান এন্টিসোরিক ঔষধ। এটি এমন একটি পলিক্রেষ্ট ঔষধ যা আমাদের দৈনন্দিন চিকিৎসা কার্যে প্রায়ই প্রয়োজন হয়। এটি ডা. হানেমানের প্রতিভার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অদ্রবণীয় পদার্থেক ঘর্ষণ ও মর্দনের মাধ্যমে তাদের অভ্যন্তরীণ শক্তির পূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে ঔষধ হিসাবে চিকিৎসা কার্যে ব্যবহার করার তিনি এক অবিনব পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। ঝিনুকের মধ্যবর্তী স্তরকে ঘর্ষণ ও মর্দনের মাধ্যমে তিনি এই ঔষধটি প্রস্তুত করেন।
সোরার প্রধান কাজই হল অন্তর্নিহিত সার্বিক এক দুর্বলতা বা ঘাটতির সৃষ্টিকরা যা মানুষকে দৈহিক ও মানসিক ভাবে দুর্বল এবং রোগ প্রবণ করে। ক্যালসিয়াম হল দেহের হাড় ও নার্ভের প্রধান উপাদান। কাজেই এর ঘাটতি মানুষকে সার্বিক ভাবে বিপর্যস্ত করে। পুষ্টির অভাব এবং তার জন্য দৈহিক, মানসিক ও ভাবাবেগের ক্ষেত্রে ব্যাপক বিরূপ প্রভাব এই হল ক্যালকেরিয়ার মূলসুর।
উৎসঃ রাসায়নিক।
প্রুভারঃ ডা. হানেমান, পরবর্তীতে হার্টম্যান,
স্ক্রেটার, রুমেল।
কাতরতাঃ প্রথম শ্রেনীর শীতকাতর।
মায়াজমঃ সোরিক, সাইকোটিক, টিউবারকুলার।
পার্শ্বঃ ডানপার্শ্বে, উপরে ডানপার্শ্বে নিচে বামপার্শ্বে,
বামপার্শ্ব হইতে ডানপার্শ্বে।
উপযোগীতাঃ সর্দিকাশিতে ভোগে, রসপ্রধান বাতরোগে ভোগে, সুন্দর চুল, ফর্সা, নীল চোখ, গায়ের চামড়া কোমল ও মোটা হওয়ার প্রবণতা, শিশুদের হাড় বেঁকে যায় বিশেষতঃ মেরুদণ্ড ও বড় হাড়গুলো বেঁকে যায়, হাত পায়ের হাড়গুলো বাঁকা ও বিকৃত। হাড়গুলো স্বাভাবিক ভাবে বাড়ে না।
ক্যালকেরিয়া কার্ব (Calcaria Carb)
নির্দেশক / চরিত্রগত লক্ষণঃ
১. দেহের স্হূলতা, শিথিলতা ও শ্লেষ্মা প্রবণতা।
২. অস্হির পুষ্টি সাধনে ইহা প্রায় অদ্বিতীয়।
৩. ব্রহ্মতালু বহুদিন নরম ও তলতল করিতে
থাকে।
৪. মাথার ঘামে বালিশ ভিজিয়া যায় ও অল্পেই
ঠাণ্ডা লাগে।
৫. পাঁচটি সুনিশ্চিত লক্ষণ। যথা – 1) দাঁত দেরীতে
উঠা 2) রিকেট, শীর্ণতা 3) রক্ত স্বল্পতা 4)
টিউবারকুলার 5) মানসিক শক্তি কম বা কমে
যায় (ক্ষয়)
৬. ক্যালকেরিয়া শীর্ন দেহও হইতে পারে এবং
কোষ্ঠবদ্ধতা ও থাকিতে পারে।
৭. ডিম খাওয়ার প্রবল ইচ্ছা কিন্তু দুধ সহ্য করিতে
পারে না।
৮. মেরুদণ্ড দুর্বল, পদদ্বয় দুর্বল এই জন্য বিলম্বে
হাঁটিতে শিখে, বিলম্বে দাঁত উঠে, বিলম্বে হজম
হয়, নড়াচড়ায় ও চিন্তায় বিলম্ব, রোগী মন্থর
শান্ত প্রকৃতির।
৯. ক্যালকেরিয়া সময় সময় হাতের তালু ও
পায়ের তালুতে জ্বালা বোধ হইতে থাকে।
কখনও বা হাত-পা অত্যন্ত শীতল ও ব্রহ্মতালু
জ্বালা করিতে থাকে।
১০. পায়ের পাতা যেন সব সময়ই ঠাণ্ডা ও ভেজা
থাকে, মনে হয় পায়ে ঠাণ্ডা ভেজা মোজা পরে
আছে। বিছানাতে ও পা দুটি সব সময় ঠাণ্ডা
হয়ে থাকে।
১১. কোষ্ঠকাঠিন্য অবস্থায় ভাল থাকে। মল
আঙ্গুল দিয়ে বের করতে হয়। উদরাময় হলে
অসুস্থ বোধ করে।
১২. রোগী বেদনাযুক্ত স্থান চাপিয়া থাকিতেই
ভালবাসে।
১৩. গভীর মাংশপেশীর মধ্যে ফোড়াঁ হইলে এবং
পুঁজ রক্ত নির্গত হয়ে শরীরের রক্ত দুষিত
হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে ক্যালকেরিয়া
প্রয়োগে পুঁজ এমন ভাবে শোষণ করিয়া লয়
যে শরীরের রক্ত বিষাক্ত হইবার কোন
সম্ভাবনা থাকে না।
১৪. ক্যালকেরিয়া যাহা খায় তাহা হজম করিতে
পারেনা প্রায়ই উদারময় দেখা দেয়।
১৫. যাহারা কাদায় বসিয়া কাজ করে তাহাদের
অসুস্থতা। মৃৎশিল্পদের মূত্র সংক্রান্ত বা
অন্যান্য রোগে এ ঔষধ কার্যকরী।
১৬. দেহের সকল স্রাবে টক গন্ধ। ঘাম, বমি, মল
টক গন্ধ। সারা গায়ে টক গন্ধ।
১৭. ক্যালকেরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ তিনটি লক্ষণ এফ।
যথা – 1) ফ্যাট – মোটা 2) ফেয়ার – দেরী 3)
ফ্লাবি – থলথলে।
১৮. ক্যালকেরিয়ার জ্বর যদি শীত করিয়া করিয়া
আসে তবে তাহা বেলা ২ টার সময় দেখা
দেয় এবং যদি শীত না করিয়া আসে তবে
তাহা বেলা ১১ টার সময় দেখা দেয়। জ্বর
একদিন বেলা ১১ টার সময় দেখা দেয় এবং
পরদিন বিকাল ৪ টায় প্রকাশ পায়।
১৯. ঋতুস্রাব আগে আগে শুরু হয়, প্রচুর
পরিমানে হয়, অনেকদিন ধরে চলে।
পরবর্তীকালে খুব কম হয় বা বন্ধ হয়ে যায়।
সামান্য উত্তেজনায় ঋতুস্রাব পুনরায় শুরু হয়।
২০. শিশু অনেক ক্ষেত্রে বাম দিক দৃষ্টি টেরা
করিয়া চায়।
২১. ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দাঁত উঠিবার সময়
উদরাময়, জ্বর, তড়কা বা আক্ষেপ দেখা দেয়।
২২. শিশুর শরীর লিকলিকে হস্তপদ সরু সরু
পেট ও মস্তক মোটা, আর গলাটি সরু।
২৩. গলা, ঘাড়, বগল, কুচকির গ্ল্যান্ডগুলো
ডিমের মত বড় ও শক্ত হয়, পাকে, ঘা হয়।
২৪. রক্তের গতি সঞ্চয় মাথায় বেশি হলে পায়ের
পাতা ঠাণ্ডা, মাথা গরম হয়। বুকে রক্তের গতি
সঞ্চয় বেশি হলে মাথা ঠাণ্ডা হয়। বক্ষ,
পাকস্থলী, পেটের রোগে হাত-পা ঠাণ্ডা থাকে।
২৫. বদ্ধ ঘরে মুক্ত বায়ুর আকাঙ্খা, পেলে সুস্থ
বোধ করে।
২৬. বেলোডোনার ক্রনিক ক্যালকেরিয়া কার্ব।
২৭. খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে এমন রোগা, লম্বা
চেহারার যুবকদের ডান ফুসফুস আক্রান্ত
হওয়ার প্রবণতা।
২৮. গর্ভাবস্থায় বেশি ক্যালশিয়াম খেলে সেই
মায়ের শিশু ক্যালকেরিয়া কার্ব হয়।
ক্যালকেরিয়া কার্ব (Calcaria Carb)
মানসিক লক্ষণঃ
১. একগুঁয়ে মনোভাব। সব কিছুতেই ভয়। কোন
কিছুকে মোকাবেলা করতে ভয়, অংকে ভীষণ
ভয়। ভয়ের কারণে খেলার চেয়ে খেলা দেখার
আগ্রহ বেশী, ইনজেকশনে ভয়। ভয়ের গল্প
শুনলেও বিচলিত হয়, ভীড়ে ভয়। দারিদ্রতার
ভয়। অন্ধকারে ভয়। জীবজন্তুর,উচ্চতার ভয়।
২. আপন মনে কথা বলে হত্যা, আগুন, ইঁদুর
বিষয়ে।
৩. ক্যালকেরিয়ার শিশুরা রাত দুপুরের পর
চীৎকার করে ওঠে তখন তাকে শান্ত করা
অসম্ভব হয়।
৪. চুরি করার অদম্য প্রবৃত্তি, টাকা পয়সা চুরি
করে।
৫. অদ্ভুত, মজার, ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে।
৬. মনে মনে ভাবে তার যক্ষা হবে, সে পাগল হয়ে
যাবে।
৭. ৮/১০ বছরের শিশুদের অন্ধকারের ভয়।
৮. ৭/১৪ বছরে সৃষ্টিকর্তা সমন্ধে জিঞ্জাসা।
৯. ১৪/১৫ বছর বয়সে উচু স্থানের ভয়।
১০. শিশুরা বাড়িতে দুষ্ট কিন্তু বাহিরে শান্ত।
ইচ্ছাঃ শীতল বাতাস, ডিম, মিষ্টি, লবণাক্ত।
অনিচ্ছাঃ মাংস, দুধ।
বৃদ্ধিঃ ঠাণ্ডা হাওয়া, ঠাণ্ডাভেজা আবহাওয়া, ঠাণ্ডা
জলে স্নান করলে বা হাত পা ধুইলে,
দণ্ডায়মান হইয়া কার্য করিলে।
হ্রাসঃ শুষ্ক আবহাওয়া, গরম উত্তাপ প্রয়োগে,
ব্যথার পার্শ্বে চেপে শুলে।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ
১. ডা. ফ্যারিংটন বলেন – ক্যালকেরিয়া কার্ব ৩০
দিনের বেলায় কয়েকটি মাত্রা সেবনে রোগীর
রাত্রে নিদ্রা হবেই হবে। ইহা যে অতি সত্য তা
আমি নিজে রোগীর ক্ষেত্রে বহুবার পরীক্ষা
করেছি।
২. ডা. কেন্ট বলেন – ক্যালকেরিয়ার একটি
বিশেষ অদ্ভুত লক্ষণ এই যে, অভ্যন্তরস্থ
যন্ত্র গুলোতে যত বেশি সুস্পষ্ট রক্ত সঞ্চয়
হয় শরীরের উপরিভাগ ততই শীতল হয়।
সতর্কতাঃ
১. ডা. কেন্ট বলেন – মনে করুন রোগীনি সর্বদাই
গরম জিনিস এবং বেশি জামা কাপড় পরিহার
করেন, খোলা বাতাস চান, অথচ এক ডজন
ক্যালকেরিয়ার পরিচালক লক্ষণ আছে,
আপনি প্রত্যেক বারই দেখবেন যে
ক্যালকেরিয়া বিফল হবে।
২. ডা. নোয়েল পুডেফাট্ বলেন – বড় শিশুদের
ক্ষেত্রে ক্যালকেরিয়ার পুনঃ প্রয়োগ চলে
(কেবলমাত্র নির্দেশিত হলে) কিন্তু বয়স্কদের
বিশেষতঃ বৃদ্ধদের বেলায় অবশ্যই সতর্কতা
অবলম্বন করতে হবে, পুনঃ পুনঃ প্রয়োগে
অনিষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা।
৩. ডা. বোরিক বলেন – বয়স্কদের ক্ষেত্রে
ক্যালকেরিয়া কখনই ঘন ঘন মাত্রায় ব্যবহার
করবেন না।
৪. ডা. আর. সি. মিলার বলেন – ক্যালি-বাই ও
নাইট্রিক-আ্যসিডের পর ক্যালকেরিয়া কখনও
দেওয়া যাবে না।
৫. ডা. কেন্ট বলেন – টিউবারকুলার রোগী যার
ফুসফুসে টিউবারকুলার গুটিকা জন্মেছে তাকে
ক্যালকেরিয়া কার্ব এবং তারপর সালফার
দিলে নিশ্চিত মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই আশা
করা যায় না সাইলেসিয়া দিলেও একই ফলহয়।
৬. ডা. হানেমান বলেন – ক্যালকেরিয়ার পর
সালফার ও নাইট্রিক-আ্যসিড ব্যবহার না করা
ভাল। কেননা এতে অবাঞ্ছিত উপসর্গ সৃষ্টি করে।
৭. ক্যালকেরিয়া কার্ব পূর্ণিমা বা অমাবস্যায়
কখনই প্রয়োগ করবেন না। কারণ ঐ দিনগুলো
ইহার রোগের বৃদ্ধি কাল।
৮. ক্যালকেরিয়ার পূর্বে বা পরে ব্রাইওনিয়া
ব্যবহাত হয় না।
৯. ক্যালকেরিয়ার পর সালফার ব্যবহাত হয় না,
সালফারের পর ক্যালকেরিয়া খুব ভাল কার্য
করে। ক্যালকেরিয়ার পর লাইকোপোডিয়াম
ব্যবহাত হয়।