পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম

পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম

পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম- যা আমাদের সময়ের ও আমাদের দেশের একটি ক্রমবৃদ্ধিমান রোগাবস্থা।

এই রোগাবস্থায় পতিত মহিলাদের ৮০%- এরই মেনে নিতে হয় বন্ধ্যাত্ব।

সৃষ্টি হয় অবর্ণনীয় দুঃখ, দুর্দশা; সামাজিক উপেক্ষা ও গঞ্জনা; সহ্য করতে হয় পরিবারের ভ্রুকুটি।

এর সাথে হরমোনের সংযুক্তি থাকায়, ভবিষ্যতে সম্ভাবনা থাকে আরো বহুমুখী জটিলতার।

নারীসুলভ গুণ ও বৈশিষ্ট্যের ব্যতিক্রম অবস্থা, যৌনাঙ্ক্ষার পরিবর্তনসহ আরো বহুপ্রকারের রোগের উৎসস্থল হতে পারে এই হরমোনাল ভারসাম্যহীনতা।

মনে রাখতে হবে,

মানুষের শরীর ও মন এমনভাবে ‍সৃষ্টি- যার একস্থানের ভারসাম্যহীনতা বা স্বাভাবিক অবস্থা থেকে বিচ্যুতি অন্য

যে কোন স্থানে তার প্রভাব বিস্তার করতে পারে- বিশেষ করে এ কথা প্রযোজ্য হরমোনের ভারসাম্যহীনতার ব্যাপারে।

কিন্তু একটু সচেতনতাই এই বিশাল সংখ্যক রোগীর সুদিন ফিরিয়ে আনার জন্য, ভবিষ্যতের সমস্ত জটিলতা ও ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাবার জন্য যথেষ্ঠ।

কেবল প্রয়োজন সচেতনতা ও এ সম্বন্ধে ন্যূনতম ধারণালাভ, সঠিক ও যথাযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণের উপযুক্ত জ্ঞান।

পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম রোগ পরিচিতি: বলতে মহিলাদের ডিম্বাশয় বা

ওভারিতে সৃষ্ট দুইয়ের অধিক বা ততোধিক সিস্ট বা তরলে পূর্ণ থলে বুঝায় যা কিনা এন্ডোজেন (পুরুষ হরমোন) নামক হরমোনের আধিক্যের কারণে হয়ে থাকে।

পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম কি?

নূন্যতম ৮-১০টা সিস্ট হলে তাকে পলিসিস্টিক ওভারি বলা হয়। প্রতিমাসে ওভারি বা

ডিম্বাশয়ে একটি ডিম্বাণু পরিপক্ব হয়ে জরায়ুতে আসে যার ফলে ঋতুচক্র হয়ে থাকে।

কিন্তু যদি কোন কারণে শরীর হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয় তাহলে একটি ডিম্বাণু পরিপক্ব না হয়ে অনেকগুলো ডিম্বাণু পরিপক্ব হতে চায়- যার ফলে ঋতুচক্রে অসামঞ্জস্যতা দেখা দেয় এবং মাসিক অনিয়মিত হয়ে যায়।

মেয়েদের হরমোন জনিত জটিলতার মধ্যে ৫-১০% হচ্ছে এই পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম।

পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমের প্রধান কারন হিসেবে এন্ডোজেনের আধিক্য এবং

দ্বিতীয় কারণ হিসেবে অনিয়ন্ত্রিত ওজন, বিশৃঙ্খল জীবনযাপন, ফাস্ট ফুডের প্রতি প্রবণতা ইত্যাদি ধরা হয়।

এছাড়াও মানসিক চাপ ও জিনগত ত্রুটি এর অন্যতম কারন। তাছাড়া, বহুপ্রকার ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত কারণে

এই রোগের হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেও অনেকে মনে করে থাকেন।

কারা বেশি আক্রান্ত হয়:

সাধারণত স্থুলকায় মহিলারা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। তারপরও শতকরা ৩০ ভাগ রোগা মহিলাও আক্রান্ত হয়।

মহিলাদের রিপ্রোডাক্টিভ এইজ বা প্রজননক্ষম বয়স থেকে শুরু করে যে কোন বয়সেই এ রোগ হয়ে থাকে।

সারা বিশ্বে ৮ থেকে ১১ শতাংশ মহিলাদের মধ্যে এর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে এবং টিনেজারদের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশই এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

লক্ষণ: পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম এর প্রধান উপসর্গ অনিয়মিত মাসিক হলেও ওজনাধিক্য, অবাঞ্চিত লোম, ব্রণ, চুল পড়ে যাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হাইপার টেনশন ইত্যাদি দেখা যায়।

৮০ ভাগ বন্ধ্যাত্বের কারণ হিসেবে এই পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমকে দায়ী করা হয়।

গর্ভকালীন বিশেষ সতর্কতা: যেহেতু পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমের ক্ষেত্রে বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাওয়া, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস, নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সন্তান প্রসব সহ নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে- তাই গর্ভকালীন সময়ে বিশেষ সতর্কতা এবং নিয়মিত চেক আপের মধ্যে থাকতে হবে।

রোগ নির্নয়ঃ আল্টাসাউন্ড, এন্ডোজেনিক ওভার এক্টিভিটি টেস্ট, ওজন ও উচ্চতা নির্নয়, লিপিড প্রোফাইল, ফাস্টিং গ্লুকোজ টেস্ট,

থাইরয়েড ফাংশনাল টেস্ট, সেরাম টেস্টোস্টেরন লেবেল, সেরাম এফ এস এইচ/এল এইচ ইত্যাদির মাধ্যমে এই রোগ নির্নয় করা যায়।

পরামর্শঃ

পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম এই ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে প্রথম পরামর্শ হলো ওজন কমানো। সেজন্য ব্যয়াম, হাঁটা এবং প্রয়োজনে ডায়াটেশিয়ানের পরামর্শ অনুযায়ী ডায়েট করা। এটি যেহেতু একটি হরমোন জনিত জটিলতা সেহেতু ওজন কমানোর পাশাপাশি চিকিৎসারও প্রয়োজন রয়েছে। হোমিওপ্যাথিতে এ রোগের আরোগ্যকারী চিকিৎসা রয়েছে। হোমিও চিকিৎসা দ্বারা এ রোগ থেকে সম্পূর্ণভাবে ও সহজেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব এবং  সেটাও কোন রকম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছাড়া।

পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা: এ প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে একদম সাম্প্রতিক একটি কেইসই উল্লেখ করছি।

রোগীটি একজন বিবাহিত নারী। বয়স ২০ বৎসর। দেড় বৎসর যাবৎ বিয়ে হয়েছে।

পারিবারিক কিছু কারণে তারা বিয়ের পর থেকেই বাচ্চা নেবার চেষ্টা করছে কিন্তু সন্তানধারণ করছে না।

১৪/০৫/২০১৯ ইং তারিখে সে আমার চিকিৎসার জন্য আসে। কেইস টেকিং করে দেখা গেলো-

তার ঋতুস্রাব শুরু থেকেই অনিয়মিত। এখন এলোপ্যাথিক ঔষধ না খেলে মাসিক হয়ই না। আর ঔষধ খেয়ে মাসিক হলেও প্রচণ্ড ব্যথায় কষ্ট পায়।

এছাড়া সারা শরীরে চুলকানি আছে। পেটের দুই পার্শ্বে ব্যথা করে, মাজায় ব্যথা আছে।

গ্যাস্ট্রিকের সমস্যাও আছে। ইদানিং তার মুখে খুব ব্রণ হচ্ছে। মাথার চুলও এই অল্প

বয়সেই পড়ে যাচ্ছে। রোগীর যৌন অনীহা বর্তমান। মিলনের সময় তার যৌনাঙ্গ শুকনো থাকে।

মুখ তৈলাক্ত, ঠোটের উপর স্বাভাবিকের তুলনায় হালকা গোঁফের রেখা। ওজন ৬৮ কেজি, যা তার উচ্চতা ও বয়সের তুলনায় বেশ বেশি।

প্রশ্ন করে জানা গেলো- ইদানিং তার ওজন একটু দ্রুতগতিতেই বেড়ে চলেছে। মেজাজ খিটখিটে থাকে- বিশেষ করে স্বামীর প্রতি। অন্য সময় মনমরা হয়ে থাকে।  

যাই হোক,

ওগুলো তার সম্পূর্ণ কেইস নয়- শারীরিক সমস্যাগুলো মাত্র। পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমে যে লক্ষণগুলো আসতে পারে- তারই বেশ কয়েকটা তার মাঝে দেখা গিয়েছিলো- যা এখানে উল্লেখ করলাম।

আমার ওখানে আসার পর স্বামীর সিমেন এনালাইসিস ও স্ত্রীর প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগুলো করাই। স্বামীর সিমেন স্বাভাবিক। কিন্তু ২১/০৫/১৯ তারিখে করা পরীক্ষার ফল অনুযায়ী রোগীর পলিসিস্টিক ওভারি ধরা পড়ে।

রোগীর পারিবারিক ইতিহাস, বংশগত রোগ, তার অতীত জীবন ও রোগ, বর্তমান লক্ষণসমষ্টির সাদৃশ্যে নেট্রাম মিউর – ১০০০ শক্তিতে প্রদান করা হয়।

ঔষধ খাবার পরপরই রোগীর সর্ববিষয়ে- এমনকি মন-মানসিকতাতেও উন্নতি লক্ষ করা যেতে থাকে। ২৬/০৬/১৯ ইং তারিখে রোগীর স্বাভাবিক ঋতুস্রাব দেখা দেয় এবং এবার আর অত তীব্র ব্যথা দেখা দেয়নি।

কেবলমাত্র পা ব্যথাটি ছাড়া আর সবকিছুতে রোগী উন্নতি অনুভব করে। যদিও তার মনমরা ভাবটি অনেকটা

চলে গিয়েছিলো কিন্তু খিটখিটে মেজাজ, স্বামীর প্রতি রাগান্বিত স্বভাব ও যৌনমিলনে অনীহা তখনও চলমান ছিলো।

২৮/০৭/২০১৯ ইং তারিখে কেইসটি পুনঃর্মূল্যায়ন করে করে এই সমস্ত লক্ষণ ও নতুন কয়েকটি পরিবর্তিত লক্ষণের (কোমর ব্যথার পার্শ্ব পরিবর্তন, যৌনাঙ্গে চুলকানি) ভিত্তিতে সিপিয়া – ২০০ প্রদান করা হয়।

পরবর্তী ঔষধের পরে ক্রমাগত উন্নতি হতে থাকে এবং ০৪/০৯/১৯ ইং তারিখে রোগীর কেইসে স্থবিরতা লক্ষ করে এবং বংশে রোগের প্রবণতা হিসেব করে কার্সিনোসিন – ১০০০০ এক মাত্রা দেয়া হয়।

এরপর থেকে রোগীর কোন সমস্যা পরিলক্ষিত না হওয়ায় – তার আবার প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করতে উদ্যোগী হই।

কিন্তু পরীক্ষার আগেই তারা সুসংবাদ জানায়- রোগী গর্ভধারণ করেছে।

তারপরও পরীক্ষা করতে তাগাদা দেয়ায় ৩০/১০/১৯ ইং তারিখে তারা আল্ট্রাসনোগ্রাম করে নিয়ে আসে।

মায়ের ওভারি স্বাভাবিক। তার বাচ্চার ডেলিভারির সম্ভাব্য তারিখ- ১১/০৫/২০২০ ইং।

যাই হোক, এর চিকিৎসা হোমিওপ্যাথিতে অত্যন্ত প্রশংসনীয় হিসেবে বিবেচিত হোমিওপ্যাথির মূলনীতিগুলো মেনে সুন্দরভাবে কেইস এনলাইসিস করে কন্সটিটিউশনাল চিকিৎসা দিলে রোগী খুব দ্রুত আরোগ্য লাভ করে।

এক্ষেত্রে যে মেডিসিনগুলো লক্ষণ অনুসারে বার বার আসতে দেখা যায়-

Apis mel, Aurum mur nat, Bovista, Calcarea carb, Colocynth, Iodium, Lachesis, Medorrhinum, Phosphorus, Pulsatilla, Sepia, Syphilinum, Natrum mur, Thyroidinum, Thuja, etc.

শেষকথা:

বহু মহিলা ও মেয়েকে কেবল এই রোগের নামটি শুনেই ঘাবড়ে যেতে দেখেছি।

অবশ্য তার কারণও আছে, টিনেজারদের জন্য এটা যেমন একদিকে তার সৌন্দর্যহানির কারণ, বিবাহিতাদের জন্য তার সংসারহানির।

বাংলাদেশের মতো দেশে বন্ধ্যাত্বের সামাজিক প্রভাব অত্যন্ত বেশি।

বহু নারীকে অপবাদ নিয়ে জীবনযাপন করতে হয়, গঞ্জনা সইতে হয়, সংসারে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা, এমনকি অনেক নারীকে বেছে নিতে আত্মহননের পথ।

এছাড়া অন্যান্য রোগসৃষ্টির জটিলতাটি তো থাকছেই। কিন্তু এই রোগটি থেকে অনায়াসে মুক্তি দিতে পারে এর যথাযথ চিকিৎসা।

তার সাথে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন দিতে পারে এ রোগটি থেকে চিরমুক্তির নিশ্চয়তা।

বহু রোগীর অনায়াস আরোগ্যের দৃষ্টান্ত আমাদের এ কথার সত্যতা প্রমাণিত করে।

কাজেই হতাশ বা নিরাশ না হয়ে, রোগটির ব্যাপারে সচেতন হওয়া এবং রোগ নির্ণয় হওয়া বা

লক্ষণ প্রকাশ করা মাত্রই এর আরোগ্যকারী চিকিৎসার শরণাপন্ন হওয়াই হবে উপযুক্ত কাজ।

2